কৃষিবিদ মো: শরিফুল ইসলাম
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। আমাদের জাতীয় আয়ের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ আসে কৃষি হতে। অথচ দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.০৬ হেক্টর। এই সামান্য জমি হতে আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য পুরাতন চাষাবাদ পদ্ধতিতে উৎপাদন করা সম্ভব নয়। তাই আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট মাটিতে নির্দিষ্ট ফসল আবাদের গুরুত্ব দেয়া হয়। অন্য ভাবে বলা যায় যে, যে মাটির যেরূপ গুণ সেই মাটিতে সেইরূপ ফসলের আবাদ করা দরকার। আর মাটির এ গুণাগুণ মাটি পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা যায় এবং মাটির উপযোগী ফসল চাষ করে মানসম্পন্ন বীজ ও ফসলের ফলন বৃদ্ধি করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়।
মাটি পরীক্ষার আগে জানা দরকার মাটি কি? মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম ও দানাদার আবরণ। পাথর গুঁড়ো হয়ে সৃষ্ট দানাদার কণা এবং জৈব পদার্থ মিশ্রিত হয়ে গঠিত হয় মাটি। সারা পৃথিবী জুড়ে এই মাটির উপরে বীজ ও ফসল ফলে থাকে। তবে পৃথিবীর সর্বত্র মাটি একরকম নয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি মুখ্য পুষ্টি উপাদান যেমন- নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, সালফার ও ম্যানেসিয়াম এবং গৌণ পুষ্টি উপাদান যেমন-দস্তা ও বোরনের অভাব দেখা দিয়েছে। তাই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করে মানসম্পন্ন বীজ ও ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা বলতে খাদ্যের লভ্যতা এবং মানুষের খাদ্য ব্যবহারের অধিকারকে বোঝায়। কোন বাসাকে তখনই ‘খাদ্য নিরাপদ’ বলে মনে করা হয়, যখন এর বাসিন্দারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বসবাস করেন না কিংবা খাদ্যাভাবে উপবাসের কোন আশঙ্কা করেন না।
মাটি ব্যবস্থাপনার সাথে খাদ্য নিরাপত্তা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। কারণ বাংলাদেশের বেশি ভাগ এলাকায় মাটিতে বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এইসব মাটির যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা কারা যায়, তাহলে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। বছর বছর ফসলের জন্ম দিয়ে দিয়ে মাটির উর্বরতা অনেকাংশে কমে গেছে বা যাচ্ছে। তাই জমিতে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হলে ফসলি জমির ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা করে তাতে প্রয়োজনে সুষম সার ব্যবহার করতে হবে। এজন্য আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট আছে। সেখানে যোগাযোগ করে কৃষি বিভাগের পরামর্শকদের মাধ্যমে এদেশের সকল অঞ্চলের কৃষকরা তাদের জমির মাটি পরীক্ষার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, সুষম সার ব্যবহারে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং ফলন ২০-২৫% বৃদ্ধি পায়। তাই, সার প্রয়োগেরে আগে মাটি পরীক্ষা করানো উচিত।
মাটি পরীক্ষা করলেই মাটিতে উপস্থিত পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ জানা যায়। জানা যায়, কোন্ পুষ্টি উপাদানের অভাব রয়েছে। এর মাধ্যমে মাটিতে কোন্ পুষ্টি উপাদান এবং কোন্ সার কি পরিমাণ সরবারহ করতে হবে তা নির্ণয় করা যায়। মাটির উর্বরতার পরিমাণ ও কি পরিমাণ জৈব পদার্থ আছে তাও জানা যায়। মাটির অম্লত্ব/ক্ষারত্ব/লবণাক্ততা জানা যায়। জানা যায়, মাটিতে উপস্থিত ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ, মাটিতে ডলোমাইট লাইম (ডলোচুন) প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা ও পরিমাণ । মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। সার প্রয়োগ করা যায় ফসলের চাহিদা অনুযায়ী। এটাই মাটির পরিচর্যা কিংবা সুরক্ষার উপায়। অতএব, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই মাটির স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি বলা যেতে পারে, মাটি পরীক্ষা করে সুষম জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে একদিকে যেমন মানসম্পন্ন বীজ পাওয়া যাবে অন্যদিকে তেমনি ফসলের ফলন বৃদ্ধি পাবে এবং এত করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
মানুষের সর্বপ্রথম চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও জীবন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের বিষয়টিকে পৃথিবী জুড়েই একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দিয়েছে। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য দরকার মানসম্পন্ন বীজ ও অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষককে সর্বোচ্চ প্রণোদনা ( বীজ, সার ইত্যাদি ) ও কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা তথা মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) কৃষককে সরাসরি প্রণোদনা দিতে না পারলেও কৃষক যাতে টেকসই ও লাভজনকভাবে মাটির ব্যবহার নিশ্চত করে মানসম্পন্ন বীজ ও অধিক খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপৃত থাকতে পারেন সে লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। আর সম্মিলিত এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জন করেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে সচ্ছল ও সুখী মানুষের দেশে পরিণত হবে। য়
পাবলিকেশন এন্ড লিয়াজোঁ অফিসার, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১৬-৫০৬০৮০ ই-মেইল : ংsharifulplo@gmail.com